রাজনীতি, জনপ্রতিনিধিত্ব ও মানবসেবা

যে মানবসেবা করে তার কি জনপ্রতিনিধি হতেই হবে? অথবা যে জনপ্রতিনিধি হয় তার কি রাজনীতি করতেই হবে? জনপ্রতিনিধি যে তার কি মানবসেবা করতেই হবে? দেখুন এই সহজ প্রশ্নগুলো আমরা যত সহজে করে ফেললাম উত্তরে গিয়ে তত সহজে আপনি উত্তর মেলাতে পারবেন কি না তার একটি অনিশ্চয়তা থেকেই যায়!

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রাজনীতি করার উদ্দেশ্যের সাথে যুক্ত হয়ে যায় জনপ্রতিনিধি হওয়ার একটি দুর্নিবার ইচ্ছা। এখন এই জনপ্রতিনিধি হওয়ার ইচ্ছার পেছনে অনেক কারণ হয়তো আছে কিন্তু যারা দোহাই দেয় মানবিক কাজ করার জন্যই আমরা সৎ, নির্ভীক, একটি দলের ভালো কর্মী বলে পোস্টারিং করে তারপর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা?

মানবতার কাজ এ পর্যন্ত যারা করছেন তারা সবাই কি জনপ্রতিনিধি। অথবা আরেকটি কারণ বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে জনপ্রতিনিধি হওয়া ছাড়া কি সত্যিই মানবিক কাজ করা যায় না? নেতৃত্ব বা জনপ্রতিনিধির কয়েকটি বিখ্যাত মানুষের বাণীর দিকে যদি আমরা যাই তবে দেখা যাবে জনপ্রতিনিধি বা নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন মানুষের ভাবনা ও কাজ কি ধরনের হওয়া উচিত!

লাও ঝু (প্রাচীন চীনা দার্শনিক) বলছেন: ‘শ্রেষ্ঠ নেতা সে-ই, যার অধীনে কোনো কিছু অর্জিত হলে তার সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষই ভাবে যে তারা সবাই মিলে কাজটি করেছে!’

জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে এই উক্তিটির কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায়! আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি তাদের কাজগুলোকে তাদের নিজস্ব অর্জন বলে চিন্তা করে থাকেন। জনগণের জন্য জনপ্রতিনিধি এ বিষয়টি এখন দিন দিনই পেছনের চিন্তা হিসেবে পড়ে থাকছে আঁস্তাকুড়ে। – এন্টনি ডি সেইন্ট (বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ লেখক ও পর্যটক) তিনি বলেছেন একটু ভিন্নভাবে -‘জাহাজ বানাতে চাইলে তোমার লোকদের কাজ ভাগ করে দিয়ে নির্দেশ দিতে থাকার বদলে, তাদের সমুদ্রের অপার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাও’ (সূত্র: গুগল)। অনেক সময়ই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কারণে অনেক ভালো কাজ পিছিয়ে পড়ে বা পড়তে বাধ্য হয়! যখনই কোনো স্বপ্নকে সামনে রেখে নেতৃত্ব পরিস্ফুটিত হবে তখনই কেবল সে কাজের পরিপূর্ণতা আসা সম্ভব। স্বপ্ন যারা দেখাতে পারে তারা অন্যদের থেকে আলাদা এবং তাদেরই জনপ্রতিনিধি হওয়া প্রয়োজন। জনগণকে টাকার বিনিময়ে কিনে কেউ যদি জনপ্রতিনিধি হতে চায় সেখানে স্বপ্নের ঘোর থাকে না সেখানে সৃষ্টি হয় ‘কু’ !

এখন এখান থেকেই আমি চলে যাচ্ছি রাজনীতির বিষয়টিতে। যখনই কোনো দেশের রাজনীতি নিয়ে আমরা কথা বলব তখনই সে দেশের একেবারে মূল থেকে আসতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাস দেখলে সেখানে দেখা যাবে অনেক বেশি আভিজাত্যের ছোঁয়া। স্বাধীনতা প্রাপ্তি থেকে আজ অবধি রাজনীতির অনেক চড়াই উৎরাই আমরা দেখেছি। কিন্তু এখন এ সময়ে এসে রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র নেতৃস্থানীয় মানুষকে পোস্টারে উপরে রেখে নিজেদের বড় করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা!

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে মানুষের কাছে গিয়ে, সাধারণ হয়ে, কৃষকের চিন্তায় ঢুকে গিয়ে রাজনীতি করে গেছেন সেভাবে এখন কজন মানুষ রাজনীতিতে আসছে। ভালো কিছু উদাহরণ ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যারা রাজনীতিতে আসছে বা আসতে চাচ্ছে তাদের মধ্যে আগে থেকেই ক্ষমতার একটি লোভ কাজ করছে। এখানে ক্ষমতার শ্রেণি-বিভাগও কল্পনা করা যেতে পারে। কেউ কেউ চাচ্ছে পেশিশক্তি আবার কেউ কেউ চাচ্ছে অর্থনৈতিক শক্তি! আর যার ফলে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ইচ্ছাগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়!

অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের আত্মজীবনীমূলক বই ‘পার্মানেন্ট রেকর্ড’ থেকে- নাগরিকরা সরকারকে ভয় পাওয়ার বদলে সরকারের উচিত নাগরিকদের ভয় পাওয়া। এখন রাজনীতির সাথে এ কথাটি যদি আমি একটু মেলাতে চাই তবে জনপ্রতিনিধি হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা তাও আবার ক্ষমতার জন্য এবং মানবতার যে বিষয়টি দেশের জন্য সবকটি বিষয় কিন্তু অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেন এ কথার মাধ্যমে বলে দিয়েছেন।

ঠিক এর বিপরীতে প্লেটো বলে দিয়েছেন অসাধারণ একটি কথা। তার উক্তিটি এমন-রাজনীতিতে অংশগ্রহণে অনীহার অন্যতম শাস্তি হচ্ছে নিজের তুলনায় নিকৃষ্টদের দ্বারা শাসিত হওয়া!

তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে রাজনীতিতে ক্ষমতার দম্ভ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল এবং এর বাইরে যারা রাজনীতি করে দেশের সেবায় এসেছেন তারাই হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত !

কিন্তু আমার এ লেখাটি রাজনীতি বা জনপ্রতিনিধিদের বিষয়ের নয়। আমি মানবিকতার বিষয়টিকেই মুখ্য বিষয় হিসেবে দাঁড় করতে চাই। ইদানীং অনেককেই দেখি মানবিক আচরণ করে তিনি জনপ্রিয় হওয়ার পর জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য বিভিন্ন দলের নমিনেশন চান। হয়তো তিনি নমিনেশন পাবেনও কিন্তু সত্যি কথা বলতে একজন মানুষের মানবিক কাজগুলো মানুষের জন্য করতে কী জনপ্রতিনিধি হতেই হয় অথবা রাজনীতি তাকে করতেই হবে? রাজনীতি করে জনপ্রতিনিধি হয়ে তারপরই কেবল মানবসেবা করতে হবে বা মানবসেবার ব্রান্ডিং করতে হবে তা কখনই সঠিক নয়। রাজনীতিক হয়ে যেমন খ্যাত হওয়া যায় তেমনি মানবসেবা করেও মানুষের কাছের মানুষ হয়ে আজীবন বাঁচা যায়। তবে রাজনীতিক হন আর জনপ্রতিনিধিই হন দুজনেরই মানবিক হতে হবে।

ইসলামের অন্যতম খলিফা হযরত ওমর (রা.) রাজনৈতিকতার সাথে সাথে জনপ্রতিনিধি হয়ে কীভাবে মানবিক হতে হয় তা শিখিয়েছেন। অন্যের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ায় যেমনি তিনি পিছিয়ে পড়েননি তেমনি তার দাম্ভিক আচরণও ছিল ইসলাম বিজয়ের পথিকৃৎ।

বিপরীতে অরাজনৈতিক মাদার তেরেসাকে আমরা দেখেছি। তিনি যেভাবে মানবসেবা করেছেন তাতে সারা বিশ্বে এখন তিনি উদাহরণ। তার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল মানবসেবা ও মানুষের জন্য কাজ।

এখন আমরা সব কিছু গুলিয়ে ফেলছি। আমরা নিজেদেরকে যেভাবেই দেখতে চাই না কেন সবার আগে ভাবতে হবে আমি মানবিক হতে পেরেছি কি না। মানবিক না হলে আপনি সফল রাজনীতিবিদও হতে পারবেন না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *